ঈশ্বরতত্ত্ব : (১) – একজন নিধার্মিকের পয়েন্ট অব ভিউ

Non-Religious' View
মানব ইতিহাসের প্রথম আধ্যাত্মিক এবং যৌক্তিক প্রশ্ন সম্ভবত “আমাদের অস্তিত্ব কেনো আছে?” এই প্রশ্ন থেকে আজকের দর্শন, বিজ্ঞান এ সকল কিছুর উদ্ভব। জিনগত ভাবে মানুষ কৌতূহলী প্রাণী। আমরা সবাই জানি আমাদের প্রাথমিক জীবন এত সহজ ও সাবলীল ছিলো না। অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর সাথে টক্কর দিয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে হোমো-সেপিয়েন্সকে। খাদ্যের জন্য শিকার করতে হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য। এত কিছুর পরও মানুষ প্রশ্ন করেছে। “আমরা কেনো আছি?”, “এই গাছ-পালা, নদ-নদী, পৃথিবী কেনো আছে?”। সেই সময় মানুষ জানত না বর্জ্রপাত কেনো হয়, প্রাকৃতিক দূর্যোগ কেনো হয়, মানুষ জন্ম কেনো নেয়, মৃত্যু কেনো হয়। শিকরের প্রশ্ন, আমাদের অস্তিত্ব কেনো আছে? খুব সরল ও স্বাভাবিক বিচারে আমরা দালান তৈরি করি বলে সেই দালানের অস্তিত্ব আছে, আমরা গাছ রোপণ করি বলেই সেই গাছের অস্তিত্ব আছে। এসকল চিন্তা ভাবনা থেকে প্রথম চিন্তাবিদগণ ধারণা দেন কেউ একজন আমাদের তৈরি করেছে। তখন মানুষ জ্ঞানের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলো। পাশবিক, বর্বর (যারা মাত্র সভ্য হতে শিখতে শুরু করেছিলো। গড়ে তুলেছিলো সভ্যতা। অনেক সময় তা বর্বর সভ্যতা) ও প্রকৃতির নানা কার্যকলাপে বিস্মিত মানুষদের কাছে এটা এক যুগান্তকারী ধারণা ছিলো। যার পেছনে খুব স্বাভাবিক যুক্তি কাজ করত। আর তা হলো, আমাদের কেউ তৈরি না করতে আমরা কোথায় থেকে এলাম?
কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো কে আমাদের তৈরি করলো? এবং কেনোই বা তৈরি করলো? চিন্তাবিদগণ কখনো অলস সময় কাটান নি। মানুষ ও তার ক্ষমতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলো। আর এটুকুও তারা বুঝতে শিখেছিল যে, আমাদের ক্ষমতা যদি এমন হয় তাহলে আমাদের যে তৈরি করেছে তার ক্ষমতা কতটা হতে পারে। কে আমাদের তৈরি করেছে এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ কখনোই খুঁজে পায় নি। তবে কেউ একজন যে তৈরি করেছিলো এটা তারা মেনে নিয়েছিলো। এভাবেই প্রথম তৈরি হলো ঈশ্বরের ধারণা। অজানা, অদেখা, অচেনা কোন এক শক্তি হয়ে উঠলো এই গ্রহের সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্ক ওয়ালা প্রাণীর জীবন যাত্রার কেন্দ্রবিন্দু।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি, অর্থাৎ, ঈশ্বর কেনো আমাদের তৈরি করলো, এই প্রশ্নটিই সমাজ এর আমূল বদলে দিলো। মানুষ আসলে এই প্রশ্নটিরও কোন উত্তর খুঁজে পায় নি। তবে ততদিনে মানুষ ভক্তি, শ্রদ্ধা এই জিনিসগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। তারা এটা মানত যে, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এই অমূল্য জীবন দান করেছেন তার প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ইত্যাদি প্রদর্শন করা প্রয়োজন। এই জিনিসটা খুব একটা খারাপ ছিলো না। এই কেউ (ঈশ্বর) কে ঘিরে মানব সমাজে উদ্ভব হতে থাকলো নানা আচার অনুষ্ঠান, উৎসব। যা শিকারি এবং কৃষিকাজ করা মানুষদের জীবনে নিয়ে আসলো এক নতুন আমেজ। জীবন হঠাত করেই অন্যরকম হতে শুরু করেছিলো।
চিন্তাবিদগণ থেমে ছিলেন না। ঈশ্বরের ধারণা নিয়েই শুধু তারা পরে থাকেন নি। তাদের চিন্তাধারা ততদিনে কয়েকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। কেউ চিন্তা করত ঈশ্বরকে নিয়ে, কেউ প্রকৃতি, কেউ মানুষের জীবন যাত্রা নিয়ে। প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করা মানুষগুলো তখন ঈশ্বর আর প্রকৃতির মধ্যে কিছু একটা মিল খুঁজে পেলেন। তারা প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে পেলেন ঈশ্বরকে। যেহেতু তখনকার মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বর্জ্রপাত, বৃষ্টি এগুলোর কারণ জানত না, তাই মানুষ এগুলো ঘটনার জন্য দায়ী করে দিলেন ঈশ্বরকে। ঈশ্বর কেনো এগুলো করেন তারও একটি করে কারণ পেশ করলেন তারা। মানুষ ধীরে ধীরে ঈশ্বরের ভক্তি ও শ্রদ্ধা করার যথেষ্ট কারণ ও প্রয়োজনীয়তা বোধ করতে লাগলো। যেমন ঈশ্বর রেগে গেছেন বলে বর্জ্রপাত হচ্ছে, দাবানল হচ্ছে, আবার ঈশ্বর খুশি বলে রংধনু উঠছে। প্রকৃতির এই সকল খামখেয়ালীপনা ব্যাখ্যা করতে মানুষ ঈশ্বরের ব্যবহার শুরু করে। তারপর প্রকৃতির মাঝেই দেখা মেলে ঈশ্বরের। সূর্য্য ঈশ্বর, বৃক্ষ ঈশ্বর, সমুদ্র ঈশ্বর ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ঈশ্বরের দেখা মিলতে শুরু করে একে একে। প্রথম শুরু হয় সাম্প্রদায়িকতা। যে যাকে ঈশ্বর হিসেবে বেছে নেয় সে সবদিক থেকে (আচার-অনুষ্ঠান, জীবন যাপন, চিন্তাধারা) আলাদা হয়ে পরে অন্য ঈশ্বরকে বেছে নেওয়া মানুষদের থেকে। শুরু করে ভিন্নভাবে বসবাস করতে। নানান ঈশ্বরের পূজারীদের আচার-অনুষ্ঠান ও জীবন যাত্রার ভিন্নতা পৃথিবীতে তৈরি করে বিচিত্রতা। সুন্দর হতে থাকে পৃথিবী। এদিকে চিন্তাবিদগণ তখন ঈশ্বর কেনো আমাদের তৈরি করেছেন তার কারণ ও খুঁজে পেতে শুরু করেছে। তিনি চান আমরা সবাই ভালো কাজ করি এবং তার সেবা, ভক্তি, পূজা ইত্যাদি করি। তখনকার প্রায় অসভ্য ও বর্বর মানুষের ওপর এই জিনিসটি চমৎকার কাজ করলো। সৃষ্টি হলো নৌতিকতার ধারণা এবং তা জুড়ে গেলো ঈশ্বরের ধারণার সাথে বা ধর্মের সাথে। এখনো অনেকেই মনে করেন ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা অসম্ভব।
মানুষ যখন প্রকৃতির সব কিছু ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরকে ব্যবহার শুরু করলো তখন প্রকৃতি নিয়ে মানুষের প্রশ্ন কমতে থাকলো। কারণ ঈশ্বরই সকল প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু এবার সত্যি বিপদে পরে গেছে বেচারা ঈশ্বর। কারণ মানুষ এবার প্রশ্ন করতে শুরু করলো স্বয়ং ঈশ্বরকে নিয়ে। চিন্তাবিদগণ ধীরে ধীরে ঈশ্বরের ধারণার নানা খুঁত খুঁজে পেলো। যারা চিন্তা করত তাদের কাছে ঈশ্বরের ধারণা ক্রমস ফ্যাঁকাসে হয়ে এসেছিলো। কিন্তু ততদিনে ঈশ্বর অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেছেন। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের পরতে পরতে ঈশ্বর তার আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছেন।
ঈশ্বরের ধারণাকে ধর্মতে রূপ নিতে সময় লেগেছে অনেক, কাঠ-খড়ও পোড়াতে হয়েছে। তৈরি হয়েছে অনেক নীতি, অনেক সংস্কৃতি আর অনেক ঈশ্বর। মানুষ আলাদা হয়ে পরেছে তাদের ধারণার দিক থেকে, ধর্মের দিক থেকে। এখন তাদের মাঝে আরও আছে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী মানুষদের একটি দল, সন্দেহবাদীদের একটি দল এবং নিধার্মিক। আবার ফিরে যেতে হচ্ছে তখন, যখন মানুষ ঈশ্বরকে নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
ঈশ্বরের ধারণা তৈরি হবার একদম প্রাথমিক প্রশ্নই এবার ঈশ্বরের ধারণার ভিত নাড়িয়ে দিলো। প্রথম ক্ষেত্রে প্রশ্নটি ছিলো আমরা কেনো আছি? কোথায় থেকেই বা এলাম? আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হলো ঈশ্বর কেনো আছে? ঈশ্বর কোথায় থেকে এলো? আগের মত এবারেও সবচেয়ে সহজ যুক্তি হলো ঈশ্বরকে কেউ সৃষ্টি করেছে। ধরে নিলাম, “অতি-ঈশ্বর” “ঈশ্বর” কে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই “অতি-ঈশ্বর” কেও তো কারও না কারও তৈরি করতে হয়েছে। আবার ধরে নিলাম, “অতি-অতি-ঈশ্বর” “অতি-ঈশ্বর” কে সৃষ্টি করেছেন। এভাবে চলতেই থাকবে, যা অসম্ভব। কখনো বা কখনো, কোনও না কোনও কিছু শূন্য থেকেই তৈরি হয়েছিলো। এক্ষেত্রে ঈশ্বরে অবিশ্বাসীরা বলেন,” এই মহাবিশ্ব (এককথায় সকল কিছু) শূন্য থেকে তৈরি হয়েছে। এখানে কোনও ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পরে নি।” কিন্তু এই মহাবিশ্ব যদি একেবারে শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে, একজন ঈশ্বর কেনো শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে না? বরং এই পুরো মহাবিশ্ব শূন্য থেকে তৈরি হবার থেকে একজন ঈশ্বর শূন্য থেকে হওয়া অনেকও সহজ।
তাই এখানে একটা কনফিউশন থেকে গেলো যে, আসলেই ঈশ্বর আছে নাকি নেই? কিন্তু তাতে কি আসে যায়। যদি ঈশ্বর থেকে থাকে এবং পরকাল বা বিচার থেকে থাকে, আর আমি যদি কোনও খারাপ কাজ না করে থাকি, তাহলে আমার ভয় কি? আর যদি ঈশ্বর না থাকে, তাহলে তো হয়েই গেলো। এটাই মূলত একজন নিধার্মিকের পয়েন্ট অব ভিউ। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়।  
চলবে…

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for your comment. Happy Scienceing...