একজন সফল ভবিষ্যতদ্রষ্টা

আজকের কল্পনা, আগামীকালের বাস্তবতা। সবাই কল্পনা করতে পারে না। যারা পারেন, তাদের মাঝে একটি অন্যতম নাম হলো জুলস ভার্ন (Jules Verne)। তার সাহিত্য জীবন প্রধানত শুরু হয় ১৮৫০ সালে। এর পর লিখেছেন টানা ৫৫ বছর। ১৮৫০ থেকে ১৯০৫, এই ৫৫ বছরের সাহিত্য জীবনে তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন, এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড, আরো অনেক কল্পবিজ্ঞান। শুধু কল্পবিজ্ঞান বললে ভুল হবে, জুলস ভার্ন এর একেকটি উপন্যাস ছিলো একেকটি স্বপ্ন। যা আমাদের মত বিজ্ঞান প্রেমিদের দেয় রোমাঞ্চ, দেখায় স্বপ্ন, ভাবতে শেখায় নতুন করে।

Jules Verne (1828-1905)
জুলস ভার্নের কল্পনাগুলো ছিলো বিস্তৃত। কতটা সৃজনশীল ও প্রখর চেতনার অধিকারী হলে একজন মানুষ এতোটা দুরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে পারে আমার জানা নেই। তিনি তার লেখায় এমন কিছু কল্পনার কথা লিখে গেছেন, যা একসময় কল্পনা করাও ছিলো যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু এখন তা আমাদের কাছে, দৈনন্দিন তুচ্ছ ব্যাপার। তিনি কল্পবিজ্ঞান লিখতেন, কিন্তু তা কখনই গাঁজাখুরি মনে হত না। প্রতিটি কল্পনার মাঝে উঁকি দেয় আজকের বর্তমান। আর তখনকার জন্য, সোনালী ভবিষ্যত।  আজ আমারা তেমন কিছু কল্পনার কথাই জানবো।







ইলেকট্রিক সাবমেরিন: প্রথম সাবমেরিন তৈরি হয় ফ্রান্সে। ১৮৬৩ সালে, যা চলতো বাতাসের সাহায্যে। ১৮৬৭ সালে স্প্যনিশ প্রকৈশলী নারসিস মনটুরিওল ইঞ্জিনের সাহায্যে সাবমেরিন তৈরি করেন। যেটি পানির নিচে দুই ঘন্টা থাকতে পারতো। ঐ সময় সাধারণত বাষ্প-বাতাস নির্ভর সাবমেরিন তৈরি করতেন। এরপর তারা ১৮৮৮ সালে বৈদ্যুতিক সাবমেরিন তৈরির চেষ্টা করে। ঐ সাবমেরিন প্রকল্পটি অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। একই সালে ফরাসি নৌবাহিনী জিমনোট নামের একটি সাবমেরিন তৈরি করে। এই সাবমেরিনটি ২০৪ টি ব্যাটারির সাহায্যে চলতো। কিন্তু জুলস ভার্ন তারও ১৮ বছর আগে, অর্থাৎ, ১৮৭০ সালে ইলেকট্রিক্যাল সাবমেরিন এর কথা লিখেছেন তার বিখ্যাত উপন্যাস "টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি" উপন্যাসে। তখন সাবমেরিন তো দূরে থাক, ইলেক্ট্রিসিটির মাধ্যমে যে কোনো যানবাহন চলতে পারে, এটাও কারো জানা ছিলো না। এই উপন্যাসে ক্যাপ্টেন নিমোর একটি তিমি মাছের আকৃতির সাবমেরিন ছিলো, যার নাম নটিলাস। যার পুরোটাই চলতো বিদ্যুতের সাহায্যে।
20000 Leagues Under The Sea

বর্তমান সাবমেরিন

নটিলাস
সৌর পালঃ ১৮৬৫ সালে জুলস ভার্ন  ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন  লেখায় পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়ার একটা যন্ত্রের কথা বলেন। মানুষ সেই যন্ত্রের মাধ্যমে নভো খেয়াযান দিয়ে চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। ২০১০ সালে জাপান এমন একটি সৌর পাল মহাকাশে উতক্ষেপণ করে। নাসাসহ বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মতে জুল ভার্নের ভিন্নমাত্রিক আগ্রহ তার কল্পনাকে বিস্তৃত করে দিয়েছে। এ জন্য তাঁকে কল্পনার যাদুকরও বলা যায়।
Solar Sail
নুনার মডুলাসঃ মানুষ চাঁদে যাওয়ার কয়েক যুগ আগে জুল ভার্ন চাঁদে যাওয়ার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্রের কথা বলেন। এই যন্ত্রটি ছিলো ত্রিকোণাকৃতি। অনেকটা এখনকার রকেটগুলোর মত। জুল ভার্ন এগুলোর নাম দেন 'প্রোজেক্টাইল'। এই যন্ত্র চালানোর জন্য জুল ভার্ন একটি ইঞ্জিনের পরিকল্পনা করেন, যা এই প্রজেক্টাইলকে অভিকর্ষের বাধা পেরিয়ে মহাকাশে নিক্ষেপ করবে।
Lunar Modules
স্কাইরাইটিংঃ "ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯" বইয়ে জুল ভার্ন এটমস্ফরিক এডভ্যার্টাইজমেন্ট নামে এক বিশেষ বিজ্ঞাপণ প্রচার পদ্ধতির কথা বলেন। যেই পদ্ধতিতে বিজ্ঞাপণ আকাশে লেখা থাকবে। সবাই  সে বিজ্ঞাপণ পরতে বাধ্য। তার ২৫ বছর পরে ১৯১০ সালে প্রথম আকাশে লেখার চেষ্টা করার খবর পাওয়া যায়। ১৯৪০ দশকে পেপসি আকাশে বিজ্ঞাপণ লেখা প্রচার করে।


ভিডিও কনফারেন্সিংঃ "ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯" বইয়ে জুল ভার্ন ফোনোটেলিফোটো নামক একটি ব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে মানুষ দূর থেকে কথা বলতে পারবেন এবং তার যুক্ত একটি আয়নায় তারা পরষ্পরের ছবি দেখতে পারবে। ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯ লেখার ১০০ বছর পরে, ১৯৯০ দশকের পরে আমরা ইয়াহু মেসেঞ্জার,  স্কাইপি ইত্যাদির বদৌলতে হরহামেশাই ভিডিও কনফারেন্সিং করে থাকি। ১৯৬০ দশকে বিভিন্ন মহাকাশ মিশন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা শুরু হয়।জুল ভার্ন তারও ৭০ বছর আগে ভিডিও কনফারেন্সিং এর ধারণা দিয়ে যান।


নভোযান অবতরণঃ ১৯৫০ সালের পর থেকে মহাকাশ ফেরত যানগুলোকে বেলুনের সাহায্যে সমুদ্রে অবতরণ করানো হত। ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন গল্পে চাঁদ থেকে পৃথিবিতে আসা নভোযানগুলো সমুদ্রে অবতরনের কথা জানান জুল ভার্ন। ১৮৬৫ সালে লেখা এই উপন্যাস, তারও ১০৪ বছর পর ১৯৬৯ সালে মানুষ চন্দ্র জয় করে। এপোলো ১১ মহাকাশযান বেলুনের সাহায্যে প্রসান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে।


হেলিকাপ্টারঃ "রোবার দ্য কনকুয়েরার" উপন্যাসে একটি বিশেষ যন্ত্রের কথা বলেন জুল ভার্ন। যা পাখার সাহায্যে চলে। সেই সময় হেলিকাপ্টার তৈরির ধারণা প্রচলিত হলেও তা কয়লার মাধ্যমে চালানোর ধারণা করা হত। জুল ভার্ন প্রথম তা বিদ্যুতের মাধ্যমে চলার ধারণা দেন।


টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার ও টক শোঃ ১৯২০-১৯৩০ দশকে প্রথম টেলিভিশন উদ্ভাবনের খবর জানা যায়। ১৯৩০ দশকে লায়েল থমাস প্রথমবারের মত টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপন করেন। শুরুতে  WNBT  চ্যানেলে সেই সংবাদ প্রচার করা হত কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ১৯৪১ সালে দিনে দুবার করে সংবাদ প্রচার করা শুরু হয়। এরও ৫১ বছর আগে জুল ভার্ন টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার আর উপস্থাপনার কথা জানান। ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯ বইয়ে জুল ভার্ন লেখেন,
তখন মানুষ এমন উপায়ে সংবাদ দেখবে, যা প্রতিদিন সকালে মানুষকে সংবাদ দেখাবে। সেই সংবাদ অনুষ্ঠানে রাজনিতীবিদ, সাংবাদিক আর বিজ্ঞানীদের নিয়ে আলোচনা করবেন। 
 সেই ধারাবাহিকতায় বলা যায় আজকের যে টক শো আমরা দেখি, তা শত বছর আগে জুল ভার্নই ধারণা করে গেছেন।

আজ যা কল্পনা, তা আগামীকালের বাস্তবতা। জুল ভার্ন একজন সফল কাল্পনার পথিকৃত, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টা। কল্পনা করতে থাকো, আগামী পৃথিবী তোমার কল্পনার মাঝেই বাস্তব দেখবে। 

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

তথ্য ও আইডিয়া: কিশোর আলো

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for your comment. Happy Scienceing...